আবহাওয়া অধিদপ্তরের বার্তা অনেকের কাছে অস্পষ্ট, কারণ কী
আবহাওয়া অধিদপ্তরের চেয়ে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের পূর্বাভাসে বেশি আস্থা খায়রুল কবিরের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থীর কাছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসের ভাষা অনেক ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য ও অস্পষ্ট মনে হয়।
খায়রুলের মতে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের বার্তাগুলো সুনির্দিষ্ট নয়। যেমন ঠিক কোথায় কখন বৃষ্টি হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা হয় না। যা বলা হয়, তার ভাষাও জটিল। বাস্তব অবস্থার মিল কম।
খায়রুলের মতো অনেকেই আছেন, যাঁদের কাছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস নিয়ে ইতিবাচক কথা কম শোনা যায়। ‘বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রতি জনআস্থার নানা দিক’ শীর্ষক এক জরিপভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৯ শতাংশ মানুষের কাছে আবহাওয়ার বার্তা স্পষ্ট নয়। দুর্বোধ্যতা ও অস্পষ্টতার কারণে এ পূর্বাভাসের প্রতি তাদের আস্থা কম।
দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা বলছেন, দুর্বোধ্যতা, অস্পষ্টতা ও সুনির্দিষ্ট না করার কারণে আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের জরুরি বার্তাগুলোর গুরুত্ব নষ্ট হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন, আধুনিকায়ন প্রয়োজন।
এ অবস্থায় আজ ২৩ মার্চ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব আবহাওয়া দিবস’। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘জলবায়ুবিষয়ক কার্যক্রমে অগ্রাধিকার।’
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল গবেষক দেশের ৮ বিভাগের ২৮৬ জন উত্তরদাতার ওপর জরিপের ভিত্তিতে গবেষণা করেছেন। গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ এই জরিপ চলে।
কেন এই গবেষণা, উত্তরে আমিনুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়ার তথ্য জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এই তথ্যের মূল উৎস হলো আবহাওয়া দপ্তর। কাজেই এই প্রতিষ্ঠান ও তাদের দেওয়া তথ্যের বিষয়ে মানুষের ধারণা ও আস্থার জায়গাটা বোঝা জরুরি। সেই বিবেচনা থেকে তাই এ গবেষণা। ওয়েবভিত্তিক এ জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭২ পুরুষ, ১১৪ জন নারী ছিলেন। তাঁদের ৮৮ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫–এর মধ্যে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বার্তা, এর প্রয়োজনীয়তা, বিশ্বাসযোগ্যতা, যথার্থতা, বার্তা পাওয়ার উপায় ও ধরন—ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করা হয় জরিপে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বার্তা কতটুকু স্পষ্ট, এ প্রশ্নে ৬৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বার্তা অস্পষ্ট ও সাধারণ মানের। বাকি ৩১ ভাগ মনে করেন এ বার্তা বোধগম্য।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যে আস্থা আছে মাত্র ৩ শতাংশ উত্তরদাতার। ‘কিছু পরিমাণ’ আস্থা আছে ৩৩ শতাংশের। বাকি ৬৪ শতাংশের আস্থা ‘একেবারেই সামান্য’। বার্তার গুরুত্ব বিষয়ে ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, এই বার্তার গুরুত্ব কম। বাকি ৪২ শতাংশ উত্তরদাতা ইতিবাচক উত্তর দিয়েছেন।
প্রতিদিন দুবার করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, প্রতি মাসের শুরুতে মাসমেয়াদি পূর্বাভাস, ঝড়ঝঞ্ঝার সময় বিশেষ বিজ্ঞপ্তি, বৃষ্টি বিশ্লেষণ, খরা পর্যবেক্ষণ, নৌ–সামুদ্রিক আবহাওয়াসহ নানা বিষয়ে পূর্বাভাস দেয় আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়ার বার্তায় দুর্বোধ্যতা ও সুনির্দিষ্টতার অভাব আছে বলে মনে করেন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, ভাষার দুর্বোধ্যতা তো আছে। আবার অনেক বার্তায় দেখা যায়, ‘অনেক স্থানে’, ‘কোথাও কোথাও বৃষ্টি হতে পারে’—এমন বলা হয়। মানুষ যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য না পায়, তবে এটা তার কী কাজে লাগে?
মাত্র ৫ স্টেশনে আবহাওয়াবিদ
আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের মোট ৬১টি স্টেশন থেকে পাওয়া বার্তা বিশ্লেষণ করে আবহাওয়ার বার্তা দেয়। কিন্তু এসব স্টেশনের মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে প্রশিক্ষিত আবহাওয়াবিদ আছেন। তাই চাইলেও অঞ্চলভিত্তিক তথ্য দেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৬১টি স্টেশনে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা দেওয়ার পরিকল্পনা দুই বছরের মধ্যেই বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করি।’
ভাষার দুর্বোধ্যতা ও তথ্যে মানুষের আস্থাহীনতার বিষয়ে আজিজুর রহমান বলেন, ‘সহজ ভাষায় কীভাবে তথ্য দেওয়া যায়, সে চেষ্টা করছি।’
আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ধরন কেন্দ্রীভূত বলে মনে করেন গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, পটুয়াখালীর মানুষের জন্য যে তথ্য জরুরি, দিনাজপুরের জন্য তা হয়তো দরকার নেই। তাই অধিদপ্তরের বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ উষ্ণমণ্ডলীয় একটি দেশ। এখানে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি কিছুটা ভিন্নরকম, তার পরিবর্তনও খুব দ্রুত হয়-এমন মন্তব্য আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদের। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এত নদী বিশ্বের আর কোথায় আছে। দেখা যায়, এসব নদী নিজেরাই স্থানীয়ভাবে আর্দ্রতা বহন করে। তাতে বৃষ্টি হয়। তাই এটা বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এর জন্য আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণ দরকার, সেটাই আমরা করছি।’
এই আবহাওয়াবিদ মনে করেন, কৃষকের কাছে, সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য করতে আবহাওয়া বিষয়ক প্রত্যয়গুলোকে পরিচিত করা দরকার। এ জন্য তাঁরা পরিচিতমূলক কাজও শুরু করেছেন।
আবহাওয়ার বার্তা মানুষ মাঠপর্যায়ে কীভাবে গ্রহণ করে এ নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক শামীম রেজা। তিনি এ কাজ প্রথমে করেছিলেন ২০০৭ সালে সিডরের পর। তিনি প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘তখনো দেখেছিলাম সাধারণ মানুষ আবহাওয়ার বার্তা বোঝে না। তারা নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়। এত দিন পর কিছু পরিবর্তন হয়তো হয়েছে, কিন্তু মানুষের কাছে অধিকতর বোধগম্য বার্তা বোধ হয় এখনো তৈরি করতে পারেনি আবহাওয়া অধিদপ্তর।’